কনফুসিয়াস: একজন চীনা দার্শনিকের জীবনদর্শন।

কনফুসিয়াস ছিলেন প্রাচীন চীনের একজন বিখ্যাত দার্শনিক, শিক্ষক এবং লেখক। তিনি মানুষকে সামাজিক সম্পর্ক, আচরণ, নিয়মানুবর্তিতা এবং অন্যদের প্রতি দয়ার দর্শন শিখিয়েছেন। তার জীবদ্দশায় তিনি ন্যায়বিচার, সেবা নিশ্চিতকরণ, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা মানুষের মধ্যে তুলে ধরেন। তার মৃত্যুর পর, তার উপদেশ এবং দর্শন চীনা সংস্কৃতি এবং দর্শনের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে, যা ‘কনফুসিয়ানিজম’ নামে পরিচিত। কনফুসিয়াসের শিক্ষাগুলি চীনা সংস্কৃতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে এবং আজও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে তা অনুসরণ করা হয়।

কনফুসিয়াস: একজন চীনা দার্শনিকের জীবনদর্শন।
[সূত্র: worldhistory.org]

প্রাথমিক জীবন

কনফুসিয়াসের জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ‘লু’ রাজ্যে, যা বর্তমানে কুফুর শহর নামে পরিচিত। তার প্রকৃত নাম ছিল খুন ছিউ। তার জন্মের সময়কালে সেখানে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল। কারণ সেসময় ঝো রাজবংশের পতন ঘটে এবং রাজ্য এক অরাজকতার মধ্যে দিনপাত করছিল।
যাইহোক, তার বাবা ছিলেন একজন সৈনিক যিনি কনফুসিয়াসের জন্মের মাত্র তিন বছর পরে মারা যান। পরবর্তীতে তিনি মায়ের কাছে বেড়ে উঠেন। তার মা তাকে শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলেন। অল্প বয়স থেকেই তিনি এমন শিক্ষকদের সন্ধান করতেন যারা তাকে জীবনের সব ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিতে পারে। কনফুসিয়াস একাধারে তীরন্দাজ, সঙ্গীত, ক্যালিগ্রাফি, পাটিগণিত সহ অনেক ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ইতিহাস ও কবিতা নিয়েও পড়াশোনা করেন। কনফুসিয়াস ‘লি’ নামে পরিচিত নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুশাসনের প্রতি মুগ্ধ ছিলেন। কনফুসিয়াসের ভাষ্যমতে –

“পনের বছর বয়সে আমার হৃদয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়; ত্রিশে আমি দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলাম; চল্লিশ বয়সে আমার আর কোন সন্দেহ ছিল না; পঞ্চাশে আমি স্বর্গের আদেশ জানতাম; ষাটে আমি ছিলাম মনোযোগী শ্রোতা; সত্তর বছর বয়সে আমি আমার আদর্শকে লঙ্ঘন না করে হৃদয়ের ইচ্ছা অনুসরণ করতে শিখেছি।”

[সূত্র: কনফুসিয়াস, দ্য অ্যানলেক্টস, চ্যাপ্টার-২]

শিক্ষক হিসেবে কনফুসিয়াস

তার মায়ের মৃত্যুর পর কনফুসিয়াস প্রায় তিন বছর নির্জনতা ও শোকে কাটিয়েছেন। এটা তাকে তার দার্শনিক আদর্শে মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে। এরপর তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। লি-এর প্রাচীন শিল্পকলায় সমস্ত শ্রেণীর লোককে তিনি শিক্ষা দান করেছিলেন। কনফুসিয়াস ধীরে ধীরে লি-এর মতাদর্শে একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং তিনি লু অফ ডিউকের একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। যদিও পরবর্তীতে ডিউক অফ লুকে মন্ত্রীদের বিদ্রোহের জেরে তাকে তার শহর থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। নির্বাসিত হওয়ার পর পরবর্তী ১৪ বছর তিনি আচরণ বিধি ও নৈতিকতার দর্শন নিয়ে কাজ করেন।
কনফুসিয়াস আত্মদর্শনের গুরুত্ব শিখিয়েছিলেন। বিশেষ করে সত্য ও সৎ উদ্দেশ্যকে মূল্যায়ন করা এবং নিজের সাধ্যমতো দায়িত্ব পালন করা। তার মতে –

“তীরন্দাজিতে মানুষকে পথ দেখানোর মতো অনেক কিছু আছে। যখন তীরন্দাজ লক্ষ্যবস্তুর কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্যুত হয়, তখন সে ঘুরে ফিরে নিজের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করে।”

[সুত্র: কনফুসিয়াস, দ্য ডকট্রিন অফ দ্য মিন]

কনফুসিয়াসের ছাত্ররা তাকে অনেক ভালোবাসতো এবং শ্রদ্ধা করত। কারণ ছাত্রদের সাথে তিনি বন্ধুর মত মিশতেন এবং তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও জানতেন। ছাত্রদের ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে তিনি তার শেখানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতেন। তিনি শিক্ষাদানের একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে ছিলেন না বরং এমন উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন যা তার ছাত্রদের পাঠ্য লাভে খুবই কার্যকর ছিল। পাশাপাশি ছাত্রদের আনুগত্যেও তা প্রকাশ পেত। মজার ব্যাপার হলো, তার মৃত্যুর পরে তার শিক্ষা আনুষ্ঠানিকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং সেই শিক্ষা প্রায়শই ছাত্রদের উপর বেশ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়।

আরও পড়ুন:  আব্রাহাম লিংকন: আমেরিকার সমাজ বদলে দেওয়া কালজয়ী প্রেসিডেন্ট।

শিক্ষাক্ষেত্রে কনফুসিয়াসের অবদানকে ধারণ করলে সকলেই তা থেকে উপকৃত হতে পারে। শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান নয়, বরং তিনি অনেক বাস্তবিক শিক্ষার ব্যাপারে বলেছেন যা বৃহত্তর জনকল্যাণে ও আত্ম-উন্নয়নে কাজে লাগতে পারে।
একজন আদর্শ শাসকের ব্যাপারে তার পরামর্শ:

“যদি আপনি এক হাজার রথের রাজ্য (একটি মাঝারি আকারের রাজ্য) পরিচালনা করতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই ব্যাবসায়িক দিকে কঠোর মনোযোগ দিতে হবে, আপনার আপনার প্রতিটি কথা সত্য হতে হবে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে এবং জনগণকে ভালবাসতে হবে।”

[সূত্র: অ্যানলেক্টস, চ্যাপ্টার -১]

তার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী থাকা সত্তেও কিছু মানুষ প্রায়ই তার ও তার ধ্যান-ধারনার বিরোধিতা করতো। তিনি বহু বছর ধরে তার ধারণা ও চিন্তাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, জনসেবায় যুক্ত হয়েছিলেন। তবে প্রভাবশালীদের দুর্নীতি ও স্বার্থান্বেষীতায় তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। জীবনের শেষ দিকে কনফুসিয়াস সমাজে ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। যে কারণে শেষ জীবনে তিনি জনসেবার উপর কম জোর দিয়ে পরিবর্তে, তার মূল ধারণা এবং আত্ন-সামাজিক শিক্ষার দিকে বেশি মনযোগী ছিলেন।

আরও পড়ুন:  প্রিন্সেস ডায়ানা: একজন রাজকুমারীর গল্প।

মৃত্যু

কনফুসিয়াস ২১শে নভেম্বর ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের কুফুতে মারা যান। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৭৩ বছর। কথিত আছে যে তিনি একটি আহত হরিণকে দেখে নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। দার্শনিক ভঙ্গিমায় তিনি তার আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে বলেছিলেন:

“মহা পর্বতটি অবশ্যই ভেঙে পড়বে, শক্তিশালী রশ্মি ভেঙ্গে যাবে এবং জ্ঞানী ব্যক্তি গাছের মতো শুকিয়ে যাবে।”

কনফুসিয়াস পরবর্তী সময়

যদিও তার নিজের সময়ে তার দর্শন মানুষের মাঝে তুলে ধরতে তুলনামূলকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন, তবে তার শিক্ষা ও জীবনদর্শন ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভবিষ্যতের চীনা সমাজ এবং চীনা দর্শনকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে কনফুসিয়াস একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর শিক্ষার দার্শনিক সারাংশ নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিতে দেখা যায়:

“অন্যদের শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহনশীল হওয়া এবং ভদ্রতা প্রদর্শন করা; এবং অযৌক্তিক আচরণের প্রতিশোধ না নেওয়া – এটি দক্ষিণ অঞ্চলের শক্তি এবং ভাল মানুষ এগুলো মেনে চলে। সমাজের উচ্চস্তরের ব্যক্তিদের সাথে নিম্নস্তরের মানুষদের সাথে কঠোর না হয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্প্রীতি গড়ে তোলেন, তাতেই প্রমাণ হবে আপনি আপনার শক্তিতে কতটা দৃঢ়!”

[সূত্র: কনফুসিয়াস, দ্য ডকট্রিন অফ দ্য মিন]

কনফুসিয়াস অলৌকিকতা বা কোন দেবত্বের দাবি করেননি। কিন্তু তার শিক্ষার শক্তি, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, ধার্মিক আচরণ এবং কলুষিত সংস্কৃতি সংস্কারে তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। তার তার নিজের লেখায় নিজের জীবন খুব বেশি উল্লেখ না করলেও তার পিতা-মাতার মৃত্যু এবং তার সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতার অনেক বিষয় লেখায় ফুটে উঠেছে। কনফুসিয়াসের কাছে প্রত্যাহিক সমস্যা মোকাবিলা করা, নিজের চরিত্রের সংস্কার এবং একজন ভাল ব্যক্তি হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।

আরও পড়ুন:  শায়েস্তা খান: টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত যার সময়ে।

কনফুসিয়াসের ধর্ম

যদিও কনফুসিয়াস চীনের বাইরের কোনো ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপারে খুব বেশি অবগত ছিলেন না, তবে তিনি ‘গোল্ডেন রুল’-এর একটি বৈকল্পিক প্রস্তাব করেছিলেন। এটি এমন একটি শিক্ষা যা সমস্ত ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক রাস্তার কেন্দ্রবিন্দুতে বিবেচিত হয়।

কনফুসিয়াসের আরও একটি বিখ্যাত উক্তি:

“আপনি নিজের সাথে যা করতে চান না, অন্যের সাথে করবেন না।”

Leave a Comment