হারিয়ে যাওয়া বাংলার পানাম নগরী।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনারগাঁ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মধ্যযুগীয় বাংলার রাজধানী ছিল এই সোনারগাঁ।
সে সময়ে বাংলার বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে এ অঞ্চলের গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না। আর এই সোনারগাঁয়ের বুকেই নিদ্রিত রয়েছে হারিয়ে যাওয়া এক বিস্মৃত নগর – পানাম নগরী, যা আজকের আলোচ্য বিষয়। প্রায় চারশত বছরের পুরনো এই নগরটি একসময় ছিল ধনী ব্যবসায়ীদের বসতি। আজকে আমরা ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত এই ঐতিহাসিক পানাম নগরের গল্প শুনব।

পানাম নগরী এর গোড়াপত্তন

পানাম নগর ঠিক কোন সময়ে গড়ে উঠেছিলো তা সঠিকভাবে বলা খুব মুশকিল। তবে মনে করা হয়, প্রায় ৪০০ বছর আগে এই নগরের গোড়াপত্তন ঘটে। সম্রাট ঈসা খাঁর শাসনামলে সোনারগাঁ বাংলার রাজধানী ছিল। সেই সময় থেকেই পানাম নগর আস্তে আস্তে ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে গড়ে উঠে এই নগরী টি। সোনারগাঁয়ের স্বর্ণযুগে পানাম নগর ছিল বাংলার বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। পশ্চিমাবিশ্ব ও পূর্ব এশিয়ার বণিকদের মিলনমেলা ছিলো এখানে। তৎকালীন সময়ে মোগল সাম্রাজ্যের প্রসারের সাথে সাথে পানাম নগরের স্থাপত্যকলায়ও মোগলীয় শৈলী প্রভাব বিস্তার লাভ করে। এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা কারুকাজখচিত মসজিদ, বাড়িঘর, ঈদগাহ মাঠ সাক্ষী দেয় সেই স্বর্ণযুগের। অবশ্য পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলে পানাম নগর নীল বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তবে ইংরেজদের বাণিজ্য কৌশলের পরিবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে পানাম নগরের গুরুত্ব কমতে থাকে।

আরও পড়ুন:  শায়েস্তা খান: টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত যার সময়ে।

পানাম নগরী এর নিদর্শন

পানাম নগর একসময় মসলিন শিল্পের জন্য খুবই বিখ্যাত ছিলো। ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি বণিকরা এই মসলিন কাপড় কিনতে পানাম নগরে আসতেন। শুধু তাই নয়, আরব, পারসিক, তুর্কি, চীনা, জাপানি তথা মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার বণিকরাও পানাম নগরে আসতেন। মসলিনের পাশাপাশি মসলা, মুক্তা, রত্ন, হস্তশিল্প সহ নানা ধরণের পণ্যের ক্রয়-বিক্রয় চলত এখানে।
ব্যাবসার কেন্দ্রস্থল হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন ধনী ব্যবসায়ীদের বসতিও গড়ে উঠেছিল এই নগরে। বাড়িগুলো বেশিরভাগই ছিলো একতলা থেকে তিনতলা। তাছাড়া বাড়িগুলো লাল, সাদা ও কালো মোজাইকের কারুকাজে সজ্জিত ছিল
প্রতিটি বাড়িতেই খিলান ও ছাদের মধ্যে নীল ও সাদা ছাপ দেখা যেত। বাড়িগুলোতে নকশা ও কাস্ট আয়রনের কাজ এবং পাশাপাশি তৎকালীন সিরামিক টাইলসের ব্যবহার চোখে পড়ার মত। পানাম নগরের স্থাপত্যশৈলী ছিল বাংলার স্থানীয় ও আগত বিদেশী স্থাপত্য শিল্পীদের নির্মাণ কৌশলের মিশেলে তৈরি এক অনন্য সম্মেলন। বিশেষ করে এখানে মোগল, গ্রিক ও বাঙালি নির্মাণ কৌশলের ঝলক দেখতে পাওয়া যেত।

তবে জেনে রাখা ভালো, পানাম নগর ছিল শুধু যে ধনবানদের বসতিই ছিল তা ই না, বরং এখানে ছিল মন্দির, মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনা। কারুকাজখচিত কাচের টালি দিয়ে সজ্জিত করা ছিল হিন্দুধর্মের মন্দিরগুলো, মসজিদের মিনারগুলি ছিল আকাশচুম্বী। বছর জুড়ে এই নগর জীবন্ত ছিল উৎসবের আনন্দে। দুর্গাপূজা, রাস পূর্ণিমা থেকে শুরু করে ঈদ, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করা হতো পানাম নগরে। রাস্তায় চলতো লাখ লাখ মানুষের আনাগোনা। ব্যবসায়ীদের চিৎকার, মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি ও মসজিদের আজান কোনো কিছুর কমতি ছিলো না এই নগরীতে।

আরও পড়ুন:  শায়েস্তা খান: টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত যার সময়ে।

পানাম নগরীর পতন

এটা সবাই একবাক্যে শিকার করবে যে কোনো কিছুই চিরকাল স্থায়ী হয় না। তেমনি ভাবে পানাম নগরীর স্বর্ণযুগও টেকে নি। ইতিহাসবিদদের মতে, ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বড় ধরনের কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী হয় এই অঞ্চল। ধারণা করা হয়, ভূমিকম্প ও বন্যার কারণে পানাম নগরের বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। তাছাড়া, বাণিজ্যপথের ও বাণিজ্য ব্যাবস্থার বড় পরিবর্তনও পানাম নগরের পতনের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। পূর্বের মতো বাণিজ্য না থাকায় পানাম নগর আস্তে আস্তে জনশূন্য হয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ ভারতে চলে যাওয়ার ফলে পানাম নগর আরও জনশূন্য হয়ে পড়ে।

পানাম নগরীর বর্তমান অবস্থা

অনেকদিন অনেকটা পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও বর্তমানে বেশ কিছু বছর ধরে পানাম নগর আবার জনসাধারণের আলোচ্য বিষয় হয়ে ঊঠেছে। ২০০৬ সালে World monument fund বিশ্বের ধ্বংসপ্রায় ১০০ টি স্থাপনার তালিকায় পানাম নগরীর নাম প্রকাশ করে।


১৫-২০ বছর আগেও পানাম নগরের অনেক স্থাপনা স্থানীয় মানুষদের দ্বারা দখলকৃত অবস্থায় ছিল। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের আশে পাশে স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আবার সম্পূর্ন নগরী দখলমুক্ত করা হয়। পানাম নগরে এখনো প্রায় ৫২ টির মত বাড়ি টিকে রয়েছে, যার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪০ টির বেশি বাড়ির সংস্কার করা হয়েছে। শুধু বাড়ি নয়, বেশ কিছু পুকুর ও ছোট কিছু সেতুও নতুন করে সংস্কার করা হয়। মুগল আমলে তৈরি ৩ টি সেতু এখনো রয়ে গিয়েছে, যার নাম হলো পানাম সেতু, পানামনগর সেতু ও দালালপুর পুল।

আরও পড়ুন:  শায়েস্তা খান: টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত যার সময়ে।

পুরাতত্ত্ববিদরা এখন পানাম নগরীর ধ্বংসাবশেষগুলো নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আস্তে আস্তে আরও কিছু স্থাপনা পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যার কারনে পর্যটকরাও আগ্রহী হচ্ছেন এই ঐতিহাসিক স্থানটি দেখতে।
পানাম নগরের পুনর্জাগরণের পথে যদিও কিছু বাধা রয়েছে, তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে পানাম নগরের পুনর্নির্মাণ ও সংরক্ষণ সম্ভব।

যেভাবে যাবেন পানাম নগরী

ঢাকা থেকে পানাম নগরীর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। গুলিস্তান থেকে সোনারগায়ের মোগড়াপাড়া যাওয়ার বাস রয়েছে। প্রায় ১ থেকে ১:৩০ ঘণ্টার পথ এটি। মোগড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা কিংবা অটোরিক্সা দিয়ে সহজেই চলে যেতে পারবেন পানাম নগরী।
পানাম নগরীতে প্রবেশ মূল্য ১৫ টাকা। তাছাড়া পানামের জাদুঘরে প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা।
পানাম নগরী প্রতি রবিবার বন্ধ থাকে। অপরদিকে ছুটির দিনগুলোতে শুধু মাত্র জাদুঘর বন্ধ থাকে।

Leave a Comment