আমাজন বন নিয়ে যাবতীয় সব তথ্য।

আমাজন বন নিয়ে সবারই অনেক কৌতূহল থাকে। থাকবে না ই বা কেন? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন নিয়ে কথা! তাহলে জেনে নেওয়া যাক রহস্যময় এই বন সম্পর্কে।
আমাজন বন বা রেইনফরেস্ট হল বিশ্বের বৃহত্তম আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় বন। এটাকে প্রায়শই “পৃথিবীর ফুসফুস” নামে ডাকা হয়। কারণ এই মহাবনটি দক্ষিণ আমেরিকার নয়টি দেশে বিস্তৃত, যার ৬০% ব্রাজিলে, ১৩% পেরুতে, ১০% কলম্বিয়াতে এবং বাকি অংশ ভেনিজুয়েলা, পেরু, ইকুয়েডর, সুরিনাম, বলিভিয়া, ফ্রেঞ্চ গায়ানা ও গায়ানাতে অবস্থিত।

আমাজন বন নিয়ে যাবতীয় সব তথ্য।
আমাজন বন


বনটির আয়তন প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার (২১ লক্ষ বর্গমাইল)। বলে রাখা ভাল, এটি ব্রিটেনের চেয়ে প্রায় ২৫ গুণ বড়!
এর আকার ও বিশালতার কারণে এটিকে পৃথিবী গ্রহের সবচেয়ে বড় ও উল্লেখযোগ্য বাস্তুতন্ত্র বলা হয়। এই বন বৈশ্বিক কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রায় ৪০ শতাংশ শোষণ করে এবং বিনিময়ে আমাদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেয়। তথ্য মতে, আমাজনের আনুমানিক ৩৯০ বিলিয়ন গাছ সালোকসংশ্লেষণে সক্ষম।
আমাজন বনে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী, যাকে আমাজন নদী নামে ডাকা হয়। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৪০০ কিলোমিটার। এ তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে বিখ্যাত নীল নদ যার দৈর্ঘ্য ৬৬৫০ কিলোমিটার, যা আমাজন নদী থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার বেশি।

আমাজন বনের আবহাওয়া

আমাজন বন হলো এক ধরনের গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্ট যা বিষুবরেখার খুব কাছাকাছি অবস্থিত। জঙ্গলটির গড় তাপমাত্রা প্রায় ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে ঋতু ভেদে এই তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি থেকে ২২ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠানামা করে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি জঙ্গলে প্রতি বছর ১৫০০ মি.মি. থেকে ৩০০ মি.মি. প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। ডিসেম্বর থেকে মে মাসে আমাজন বনের আদ্রতা আনুমানিক ৮৮% এবং শুষ্ক মৌসুমে গড় আদ্রতা আনুমানিক ৭৭% হয়ে থাকে। এমনকি জঙ্গলে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। তবে সময়ের সাথে সাথে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং বন উজাড়ের ফলে ভবিষ্যতে বনের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং বৃষ্টিপাতের ধরনও পরিবর্তিত হতে পারে। যা বন, বন্যপ্রাণী, গাছপালাসহ পুরো বাস্তুতন্ত্রের জন্যই হুমকিস্বরূপ হতে পারে।

আরও পড়ুন:  সেন্টিনেলিজ জাতি: নিষিদ্ধ সেন্টিনেল দ্বীপের আদিবাসী।

আমাজন রেইনফরেস্ট কবে তৈরি হয়েছিল?

লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে আজকের এই বিস্তৃত আমাজন বন। ধারণা করা হয় আমাজন বন ৫৫ লক্ষেরও বেশি পুরনো, যার উৎপত্তি শুরু হয় বরফ যুগ থেকে। বরফ যুগে আমাজন রেইন ফরেস্ট অঞ্চলটি সাভানা দ্বীপে বিভক্ত ছিল। সে যুগের পরে সেখানকার মাটি আবার উর্বর হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে আমাজন বনের সূচনা হয়।

আমাজনের আদিবাসী

৯ টি দেশে বিস্তৃত আমাজনে ২ কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করে। পাশাপাশি ৩৫০ টিরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায় এ অঞ্চলে বসবাস করে এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বনের উপর নির্ভরশীল। বেশিরভাগই তাদের পূর্ব পুরুষদের মত এখানে বসবাস করছে। এমন অনেক আদিবাসী আছে যাদের এলাকায় নিজস্ব সম্প্রদায় ব্যাতিত অন্য কেও সেখানে সহজে প্রবেশ করতে পারে না।

আমাজনের উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ

আমাজন রেইনফরেস্টে ৪০ হাজার এরও বেশি বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতি, প্রায় ৪২৮টি স্তন্যপায়ী প্রাণী , ১৩০০ এর মত পাখি, ৩৭৮টি বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ, ৪০০টিরও বেশি উভচর প্রাণী এবং প্রায় ৩০০টি মাছের প্রজাতি রয়েছে। আমাজনের উল্লেখযোগ্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে জাগুয়ার, স্লথ, দৈত্যাকৃতির ওটার, সবুজ অ্যানাকোন্ডা, ব্ল্যাক কেম্যান নামক বৃহৎ আকৃতির সরীসৃপ, ইঁদুর গোত্রীয় প্রাণী ক্যাপিবারা, টোকান ও ম্যাকাও নামক পাখি, বিষাক্ত ডার্ট ব্যাঙ, আমাজন রিভার ডলফিন, হাউলার বানর, হার্পি ঈগল, পিরানহা, গোলাপী ডলফিন, গ্ল্যাডিয়েটর ব্যাঙ ইত্যাদি।

আমাজন বন নিয়ে যাবতীয় সব তথ্য
সবুজ অ্যানাকোন্ডা


তাছাড়া আমাজন জঙ্গলে ২৫ লক্ষেরও বেশি বিভিন্ন প্রজাতির কীট পতঙ্গ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্লিয়ার-উইংড প্রজাপতি, এলিফ্যান্ট বিটল এবং দৈত্যাকার মাকড়সা ট্যারান্টুলা ইত্যাদি।
আমাজন বন এ ১৬ হাজার প্রজাতির প্রায় ৪০০ বিলিয়ন গাছ রয়েছে। তবে রেইনফরেস্টের সমস্ত গাছের প্রায় অর্ধেক মাত্র ২২৭ প্রজাতির অন্তর্গত বলে মনে করা হয়। আমাজনের উল্লেখযোগ্য গাছের মধ্যে রয়েছে রাবার, কোকো, আকাই পাম গাছ, জায়ান্ট ওয়াটার লিলি, স্ট্র্যাংলার ডুমুর, আনগুরাহুই গাছ ইত্যাদি। হয়তো আমাজন বনে এমনও কিছু গাছ রয়েছে যেগুলো পর্যন্ত আবিষ্কৃতই হয়নি। আমাজন থেকে প্রাপ্ত ফল বিশাল পরিমানে মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। চলুন তাহলে আমাজনের কিছু উদ্ভিদ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:

আরও পড়ুন:  ফকল্যান্ড দ্বীপ পরিচিতি। বিখ্যাত ফকল্যান্ড যুদ্ধ।

কোকো গাছ: চকোলেট তৈরিতে এর বীজ ব্যবহার করা হয়।
প্যাশন ফ্লাওয়ার বা আবেগ ফুল: অদ্ভুত সুন্দর দেখতে এই ফুলগুলো। মনে হবে বাইরের কোন ফুল।
মেহগনি: কাঠ, আসবাবপত্র তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত একটি উদ্ভিদ।
হেলিকোনিয়া: এর ফুল চিংড়ির পায়ের মতো দেখতে হওয়ায় এটি ‘গলদা চিংড়ির নখর’ নামেও পরিচিত।
রাবার গাছ: এই উদ্ভিদ থেকেই রাবার পাওয়া যায়।
ব্রোমেলিয়াডস: গ্রীষ্মমন্ডলীয় একটি উদ্ভিদ যা বাড়িতে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অনেকে টবে চাষ করে থাকে।
কলাগাছ: এই ফল নিয়ে বলার কিছু নেই!
ওয়াটার লেটুস: এটা আমাজন নদীতে ভাসতে দেখা যায়।
ওয়াকিং পাম: এর শিকড়গুলো একটু অদ্ভুত, অনেকটা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের শিকড়ের মতো। পাশাপাশি এটাকে স্টিলের মতো দেখায়।

আমাজন বন নিয়ে যাবতীয় সব তথ্য
প্যাশন ফ্লাওয়ার


তাছাড়া ৭০% ক্যান্সার প্রতিরোধী ভেষজ উদ্ভিদ শুধুমাত্র আমাজন রেইনফরেস্টেই পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে:
কর্ডনসিলিওর ও ল্যাপাচো যা আধুনিক ওষুধে ক্যান্সারের চিকিৎসার কারণে সৃষ্ট ব্যথা কমাতে এবং জীবাণুর সংক্রমণ কমাতে ব্যবহৃত হয়।
ম্যাটিকো গাছের পাতা বিশেষ চা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় যা গলা ব্যথা এবং পেশীর ব্যথা উপশমে কার্যকরী।
ব্রাজিলিয়ান জিনসেং সেবনে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে।

আরও পড়ুন:  ব্রাজিলের সাপের দ্বীপ। স্নেক আইল্যান্ড।

মানবসৃষ্ট কারণে আমাজন বন ধ্বংস

পুরো বিশ্বের ইকোসিস্টেম রক্ষায় এই বনের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তবে সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে, এত বিশাল বন হওয়া সত্ত্বেও মানুষের দ্বারাই ক্রমেই এই বন উজার হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিশাল অংকের লাভের জন্য বন থেকে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ক্রমেই নিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কাঠ, প্রাকৃতিক তেল, জমি, দুষ্প্রাপ্য ফল ইত্যাদি। তাছাড়া আমাজনের জমি দখলও বল উজাড় করার উল্লেখযোগ্য একটি কারণ। যেহেতু এই জমি অনেক উর্বর, তাই অনেকেই সেখানে কৃষিকাজের চিন্তা করে। তার জন্য কিছু লোক অবাধে গাছ কাটা থেকে শুরু করে সহজ উপায় হিসাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবার বনের মাঝখানের কিছু জায়গা গাছ কেটে খালি করে ফেললে আশেপাশের গাছগুলো অচিরেই মরে যেতে শুরু করে। অনেক সময় মানব সৃষ্ট আগুন থেকে দাবানলের সৃষ্টি হয় যা বনের বিশাল অংশকে নিমিষেই পুড়ে ছাই করে ফেলতে পারে। এতে করে সেখানে বসবাস করা পশুরাও পুড়ে মারা যায়। শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই আমাজন রেইনফরেস্টে ৪০ হাজার এরও বেশি দাবানল হয়েছে শুধুমাত্র কৃষি কাজ এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে। যার কারণে ২২ লক্ষ ৪০ হাজার একর এলাকা পুড়ে ছারখার হয়ে যায় এবং ২৩ লক্ষ প্রাণী হত্যার শিকার হয়। যদিও বর্তমানে জাতিসংঘ এই সমস্যা গুলোর কিছুটা হলেও সমাধানের জন্য আমাজন বনে টেকসই উন্নয়নের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।

Leave a Comment