ক্যান্সার কীভাবে হয়? ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়।

ক্যান্সার মানবদেহের ভয়াবহ রোগ। এটি একটি বিশ্বব্যাপি সমস্যা এবং অনেক মানুষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারে নিয়মিত আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে ক্যান্সার কি সম্পুর্নরুপে ভালো হয়? তাহলে চলুন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

ক্যান্সার কি?

ক্যান্সার হল দেহে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্ট রোগ বা রোগের সমষ্টি। এই কোষগুলি শরীরের বিভিন্ন টিস্যুতে আক্রমণ করতে পারে, যা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

ক্যান্সার কীভাবে হয়? ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়।

বর্তমানে, ক্যান্সারের জন্য কোন সত্যিকারের প্রতিকার নেই। যাইহোক, সাম্প্রতিক সময়ের ওষুধ ও প্রযুক্তির অগ্রগতি ক্যান্সারের চিকিৎসার নতুন পথ তৈরি করেছে, যা আমাদের ক্যান্সার নিরাময়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।

ক্যান্সার নিরাময় কি সম্ভব? 

ক্যান্সারের কি আসলেই প্রতিকার আছে? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা প্রযুক্তিগত ভাবে এর কত কাছাকাছি অবস্থান করছি? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য, সম্পুর্নরুপে নিরাময় এবং উপশমের মধ্যে পার্থক্য বোঝা দরকার:

নিরাময়: নিরাময়ের অর্থ হল চিকিৎসার মাধ্যমে শরীর থেকে ক্যান্সারের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলা এবং নিশ্চিত করা যে এটি ফিরে আসবে না।

উপশম: উপশম বা remission মানে শরীরে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কমে গেছে বা সম্পূর্ণভাবে শরীর থেকে চলে গেছে। যে ব্যক্তি এই অবস্থার মধ্যে রয়েছেন তাদের শরীরে ক্যান্সার কোষের পরিমাণ হয়ত কমে গিয়েছে কিংবা বর্তমানে আর কোন লক্ষণ দেখা যায় না।

ক্যান্সার সম্পূর্ণ উপশমের পরেও, এ জাতীয় কোষ শরীরে থেকে যেতে পারে। এর মানে ক্যান্সার আবার ফিরে আসতে পারে। এরকম অবস্থা যদি হয়ে থাকে তবে তা সাধারণত  চিকিৎসার পরে প্রথম ৫ বছরের মধ্যে হয়। যদিও অনেক চিকিৎসক ৫ বছরের মধ্যে ফিরে না আসা ক্যান্সারের কথা উল্লেখ করার সময় “নিরাময়” শব্দটি ব্যবহার করেন, তথাপি এটি ফিরে আসা সম্ভব, যার অর্থ এটি কখনই নিরাময় হয় না। 

আরও পড়ুন:  কোলেস্টেরল কি? কোলেস্টেরল কমানোর খাদ্য তালিকা।

তাহলে চলুন কিছু নতুন ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট এর ব্যাপারে আলোচনা করি। এই ট্রিটমেন্টগুলি কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন থেরাপির মতো আরও কিছু প্রচলিত ক্যান্সার চিকিৎসার বাইরে বা তাদের সাথে ব্যবহার করা যেতে পারে। 

ইমিউনোথেরাপি

Cancer

ক্যান্সারের ইমিউনোথেরাপি হল এক ধরনের চিকিৎসা যা শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্যান্সার কোষের সাথে লড়াই করতে সাহায্য করে। ইমিউন সিস্টেম শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, কোষ এবং টিস্যু দ্বারা গঠিত যা শরীরকে বাইরের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। যার মধ্যে রয়েছে:

  • ব্যাকটেরিয়া
  • ভাইরাস
  • পরজীবী

যাইহোক, অনেক সময় আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম ক্যান্সার কোষগুলির সাথে যুদ্ধ করে পেরে উঠে না কিংবা এগুলাওকে আমাদের শরীরের অংশ হিসেবে মনে করে। এই কারণে তাদের সনাক্ত করতে বাড়তি থেরাপির দরকার হয় যাতে করে ইমিউন সিস্টেম এর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে।

ভ্যাক্সিন

ক্যান্সার কীভাবে হয়? ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়।

আপনি যখন ভ্যাকসিনের কথা ভাবেন, তখন আপনি সম্ভবত কোভিড-১৯, হাম বা ফ্লু-এর মতো সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে সেগুলোর কথা ভাবেন। যাইহোক, কিছু ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সার প্রতিরোধ এমনকি চিকিৎসা করতে সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (HPV). ভ্যাকসিন অনেক ধরনের HPV থেকে রক্ষা করে যা সার্ভিক্স, মলদ্বার এবং গলার ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া, Hepatitis B ভ্যাকসিন Hepatitis B ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, যা লিভার ক্যান্সারের জন্য দায়ী।

গবেষকরা এমন ভ্যাকসিন তৈরি করার চেষ্টা করছেন যা ইমিউন সিস্টেমকে সরাসরি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। ক্যান্সার কোষে সাধারণত এমন কিছু পার্টিকেল থাকে যা সুস্থ কোষে থাকে না। এইসব পার্টিকেল বহন করে এমন ভ্যাকসিন ব্যাবহারের ফলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম ক্যান্সার কোষগুলিকে আরও ভালভাবে চিনতে এবং ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

নিচে ক্যান্সারের কিছু উদাহরণ দেওয়া হল যা বর্তমানে ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে:

  • প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সার
  • মেলানোমা
  • স্তন ক্যান্সার ইত্যাদি
আরও পড়ুন:  সুস্থ থাকার উপায়। সুস্থ থাকার দৈনন্দিন রুটিন।

T-cell থেরাপি

T-cell হল এক ধরনের ইমিউন সেল। এরা আপনার ইমিউন সিস্টেম দ্বারা সনাক্ত করা বাইরের কোনো উপাদান বা আক্রমণকারীদের ধ্বংস করতে সাহায্য করে। T-cell থেরাপির ক্ষেত্রে এই কোষগুলিকে শরীর থেকে অপসারণ করে তাদের ল্যাবে পাঠানো হয়। যে কোষগুলি ক্যান্সার কোষগুলির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় বলে মনে হয় সেগুলি আলাদা করা হয় এবং প্রচুর পরিমাণে  এই সেলগুলোর কালচার করা হয়। এই T-cell গুলি আপনার শরীরে আবার ইনজেকশন হিসেবে দেওয়া হয়।

মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি

ক্যান্সার কীভাবে হয়? ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়।

অ্যান্টিবডি হল শরীরের B cell  দ্বারা উৎপাদিত এক ধরনের প্রোটিন, যাকে এক ধরনের ইমিউন সেলও বলা যায়। তারা নির্দিষ্ট বহিরাগত পার্টিকেলগুলোকে চিনতে সক্ষম, যাকে বলা হয় অ্যান্টিজেন। একবার একটি অ্যান্টিবডি একটি অ্যান্টিজেনের সাথে আবদ্ধ হয়ে গেলে T cell অ্যান্টিজেনকে খুঁজে পেতে এবং ধ্বংস করতে পারে। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করা সম্ভব যা সাধারণত ক্যান্সার কোষে থাকা অ্যান্টিজেনগুলিকে সনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম।

জিন থেরাপি

ক্যান্সার কীভাবে হয়? ক্যান্সার থেকে মুক্তির উপায়।

জিন থেরাপি হল আপনার শরীরের কোষগুলির মধ্যে থাকা জিনগুলির বিভিন্ন উপাদানগত পরিবর্তন করে কোনো রোগের চিকিৎসার একটি উপায়। জিন কোডিং এর মাধ্যমে শরীরে বিভিন্ন ধরণের প্রোটিন তৈরি করে। কোষগুলির বৃদ্ধি, কাজ ইত্যাদি সব এই প্রোটিনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যান্সারের ক্ষেত্রে জিন ত্রুটিপূর্ণ বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যার ফলে কিছু কোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেড়ে যায় এবং টিউমার তৈরি করে। জিন থেরাপির লক্ষ্য হল জিন এডিটিং এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত জিনগুলো সরিয়ে বা পরিবর্তন করে রোগের চিকিৎসা করা। গবেষকরা এখনও ল্যাব বা ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে বেশিরভাগ জিন থেরাপি নিয়ে কাজ করছেন।

ভাইরোথেরাপি

অনেক ধরণের ভাইরাস তাদের জীবনচক্রের প্রাকৃতিক অংশ হিসাবে তাদের হোস্ট সেলকে ধ্বংস করে। ভাইরাসের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি ক্যান্সারের চিকিৎসার অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করা যায়। ভাইরোথেরাপি হল ক্যান্সার কোষকে বেছে বেছে মারার জন্য ভাইরাসের ব্যবহার। ভাইরোথেরাপিতে ব্যবহৃত ভাইরাসগুলিকে বলা হয় অনকোলাইটিক ভাইরাস। এরা জেনেটিক্যালি মডিফাইড হয় এবং ক্যান্সার কোষে দ্রুত বংশবিস্তার করে সেগুলোকে ধ্বংস করে।

আরও পড়ুন:  চিকিৎসায় নোবেল বিজয়ী হলেন সুইডিশ জিনবিজ্ঞানী সুভান্তে পাবো।

হরমোন থেরাপি

আমাদের শরীর স্বাভাবিকভাবেই হরমোন তৈরি করে, যা আমাদের শরীরের বিভিন্ন টিস্যু এবং কোষে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করে। এরা শরীরবৃত্তিয় অনেক কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কিছু ক্যান্সার নির্দিষ্ট হরমোনের বিভিন্ন মাত্রার জন্য ভিষণ সংবেদনশীল। এই কারণেই হরমোন থেরাপি শরীরে হরমোনের মাত্রা বাড়াতে বা কমাতে ব্যবহৃত হয়। হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন কিছু  ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বেঁচে থাকাকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রয়োজনীয় হরমোনের পরিমাণ কমানো বা ব্লক করে দেওয়া এই ধরনের ক্যান্সারের বৃদ্ধিকে স্থবির করে দিতে পারে। হরমোন থেরাপি কখনও কখনও স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি প্রায়শই অন্যান্য ক্যান্সারের চিকিৎসার  পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়, যেমন কেমোথেরাপি বা টার্গেটেড থেরাপি।

সার কথা

বর্তমানে ক্যান্সারের কোন সুনির্দিষ্ট প্রতিকার নেই। এমনকি একজন ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণভাবে আরোগ্য লাভ করেন, তবুও ভবিষ্যতে তার ক্যান্সার ফিরে আসা সম্ভব। সেজন্য, গবেষকরা নতুন এবং আরও কার্যকর ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি বের করার জন্য কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রচলিত থেরাপির পাশাপাশি ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত কিছু চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে হরমোন থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপি যেমন মনোক্লোনাল এন্টিবডি, CAR T-cell থেরাপি এবং ভ্যাকসিন ইত্যাদি। এছাড়াও সাম্প্রতিককালে গবেষণার ক্ষেত্রে জিন এডিটিং, বিশেষ করে CRISPR সিস্টেম ব্যবহার করে, সেইসাথে ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করেও ক্যান্সার নিরাময়ের চেষ্টা চলছে। যদিও এই প্রযুক্তিগুলি এখনও তাদের প্রাথমিক বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে তবে প্রাথমিক গবেষণা এবং পরীক্ষাগুলি ইতোমধ্যেই আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেখিয়েছে।

Leave a Comment