বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল রহস্য : কল্পনা বনাম বাস্তবতা।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল পৃথিবীর একটি অন্যতম রহস্যময় স্থান। এটি উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিম অংশে অবস্থিত। এটি ডেভিলস ট্রায়াঙ্গেল নামেও অনেকের কাছে পরিচিত। অনেক জাহাজ ও বিমান নিখোঁজের জন্য জায়গাটির বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল অনেক জল্পনা-কল্পনা ও বিতর্কের বিষয়। যদিও কেউ কেউ বিশ্বাস করে জায়গাটি অভিশপ্ত, আবার অনেকে দাবি করে যে এগুলো প্রাকৃতিক কারণে হয়ে থাকে। যাই হোক জনসাধারনের কাছে এটি একটি রহস্য হিসেবেই পরিচিত।

রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল: কল্পনা বনাম বাস্তবতা। Bermuda Triangle

ক্রিস্টোফার কলম্বাস সর্বপ্রথম বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৪৯২ সালে পৃথিবীর নতুন নতুন জায়গা অন্বেষনে বের হয়ে তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে অদ্ভুত ঘটনার কথা জানান। কলম্বাস তার বইয়ে লিখেন, তিনি সমুদ্রে আগুনের গোলা বা ফায়ার বল বিধ্বস্ত হতে দেখেছিলেন এবং ঐ স্থানে তার কম্পাস ঠিকঠাক কাজ করছিলো না। এতে করে তার দিক নির্দেশনে সমস্যা তৈরি হয়।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কিছু অমীমাংসিত ঘটনা

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার মধ্যে রয়েছে:

ইউএসএস সাইক্লপস (১৯১৮): ইউএসএস সাইক্লপস ছিল একটি মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ যা ১৯১৮ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এ নিচিহ্নভাবে অদৃশ্য হয়ে যায়। জাহাজটিতে ৩০৬ জন ক্রু ছিল এবং ম্যাঙ্গানিজ আকরিকের একটি কার্গো ছিল। অনেক অনুসন্ধান সত্ত্বেও জাহাজের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং এর কোন ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ফ্লাইট ১৯ (১৯৪৫): ফ্লাইট ১৯ ছিল মার্কিন নৌবাহিনীর পাঁচটি বোমারু বিমানের একটি দল যেটি ১৯৪৫ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে একটি প্রশিক্ষণ মিশনের সময় নিখোঁজ হয়ে যায়। বিমানগুলি ওই এলাকার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। বিমানগুলোর সন্ধানে যে রেসকিউ টিম পাঠানো হয়েছিল তাও কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের কোন ধ্বংসাবশেষ বা মৃতদেহ পাওয়া যায়নি এবং নিখোঁজের কারণ একটি রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন:  সেন্টিনেলিজ জাতি: নিষিদ্ধ সেন্টিনেল দ্বীপের আদিবাসী।

দ্য মেরি সেলেস্ট (১৮৭২): মেরি সেলেস্ট একটি ব্রিটিশ-আমেরিকান বাণিজ্যিক জাহাজ যা ১৮৭২ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। জাহাজটি ভাল অবস্থায় পাওয়া যায়, এর কার্গো অক্ষত ছিল এবং ক্রুদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তখনও বোর্ডে ছিল। যাইহোক, ক্রু নিখোঁজ ছিল এবং তাদের নিখোঁজ হওয়ার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

দ্য উইচক্র্যাফট (১৯৬৭): দ্য উইচক্র্যাফ্ট ছিল একটি ২৩ ফুট লম্বা ভ্রমণকারী নৌকা যা  ১৯৬৭ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। নৌকাটির আকৃতি ছিল অনেক বড় এবং এটি লাইফ জ্যাকেট ও ফ্লেয়ার সহ অন্যান্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত ছিল। নৌকাটি কোস্টগার্ডের সাথে যোগাযোগের সময় হঠাৎ নিখোঁজ হয়। পরবর্তিতে অনুসন্ধান করেও নৌকা বা এর যাত্রীদের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

দ্য এলেন অস্টিন (১৮৮১): এলেন অস্টিন নামক একটি ব্রিটিশ জাহাজ লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক যাওয়ার সময় ১৯৮১ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে একটি জনমানবহীন জাহাজ খুঁজে পায়। এলেন অস্টিনের ক্যাপ্টেন সেই জাহাজটিকে বন্দরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পরবর্তিতে জাহাজটি কোনও চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যায়। নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

My bangla blog এর সকল পোস্ট গুগল নিউজে পেতে ভিজিট করুন এখানে Google news

এসব ঘটনার কারণে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল সবার কাছে রহস্যজনক জায়গা হিসেবে পরিচিত হয়েছে এবং অনেক লোক বিশ্বাস করে ঐ এলাকায় অতিপ্রাকৃত বা বহির্জাগতিক কার্যকলাপ ঘটে। যদিও এই দাবিগুলির কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।

আরও পড়ুন:  অ্যাঞ্জেল জলপ্রপাত: পৃথিবীর উচ্চতম জলপ্রপাত।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্যময় ঘটনাগুলোর প্রচলিত ব্যাখ্যা

  • একটি সম্ভাব্য কারণ হল সেখানকার পানির উচ্চ তাপমাত্রা এবং ব্যতিক্রমী বায়ু ও জলপ্রবাহ। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এর মধ্য দিয়ে বয়ে চলা উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের তাপমাত্রা আশেপাশের জলের তুলনায় বেশি, যা ঘনত্বের পার্থক্য তৈরি করতে পারে এবং স্রোতের প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে। যার কারণে জাহাজ এবং প্লেন ডুবে যেতে পারে, এমনকি কোনও চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।
  • আরেকটি কারন হতে পারে এই অঞ্চলে সমুদ্রের শক্তিশালী স্রোত। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত স্রোতের কারণে জাহাজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, যার ফলে অনেক সময় জাহাজ তলিয়ে যেতে পারে।
  • বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় অনেক জায়গা আছে যেখানে মিথেন গ্যাসের বুদবুদ তৈরি হয়। এই বুদবুদগুলির কারণে নিচের পানির ঘনত্ব কমে যেতে পারে। পানির ঘনত্ব কম হলে সেখানে জাহাজ চলাচল করা কঠিন হয়ে যায়, এমনকি খুব সহজেই জাহাজ ডুবে যেতে পারে।
  • পৃথিবীর ভৌগলিক এবং চৌম্বকীয় মেরু এক নয়। এই অসামঞ্জস্যতার কারণে কম্পাস বেশিরভাগ স্থানে চৌম্বকীয় মেরুগুলির দিকে দিক নির্দেশ করে। শুধুমাত্র অল্প কয়েকটি যায়গায় দুই মেরু একই দিকে থাকে, সেক্ষেত্রে কম্পাস অন্যদিকে দিক নির্দেশ করতে পারে। এটিও বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে কম্পাসের অসঙ্গতির একটি কারণ হতে পারে।
  • কিছু লোক বিশ্বাস করে এই অঞ্চলে দেখা উজ্জ্বল এবং রহস্যময় আলো এলিয়েনের মহাকাশযান দ্বারা সৃষ্ট, যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল টিকে ঘিরে অনেক রহস্যই যোগ করে। যদিও এই তত্ত্বকে সমর্থন করার জন্য কোন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা ভিত্তি নেই।
  • বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অদ্ভুত ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে মানুষের ভুল-ত্রুটিও একটি কারণ হতে পারে। সেই স্থানে ভুল নেভিগেশন বা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। অস্বাভাবিক আবহাওয়া, আকস্মিক ঝড় ইত্যাদিও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
  • এই অঞ্চলে জলদস্যুতা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যকলাপের কারণেও সেখানে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
আরও পড়ুন:  অ্যান্টার্কটিকা: পৃথিবীর শীতলতম মহাদেশ। Antarctica

তবে বর্তমানে গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী আদতে সেখানে কোনো রহস্যজনক ঘটনাই ঘটে না। অনেক মহল সেখানকার ঘটনাগুলোকে অতিরঞ্জিত করে সেগুলো জনসাধারণের কাছে রহস্যজনক হিসেবে উপস্থাপন করেছে। সেখানে ঠিক কতগুলো জাহাজ বা বিমান ধ্বংস হয়েছে তারও কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই।

Leave a Comment