রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন। Roman Empire

অতীত ইতিহাসে যে কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতা পুরো বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তার করেছিল তার মধ্যে রোমান সভ্যতা প্রথম দিকেই থাকবে। এই সভ্যতার মূলে ছিল ঐতিহাসিক রোমান সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য প্রায় ১০০০ বছর ধরে স্থায়ী ছিল। ইউরোপের একটি বিশাল অংশ নিয়ে ছিল সেই রোমান সাম্রাজ্য। প্রাচীন রোম কে সামরিক শক্তি, উন্নত প্রকৌশল, ধর্মীয় রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। প্রাচীন রোম সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যাই থাকুক না কেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান বিশ্বব্যাপী একটা নতুন জাগরণ নিয়ে এসেছিল।

রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন
রোমান সাম্রাজ্য


খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর শুরুতে প্রাচীন রোম মধ্য ইতালির টাইবার নদীর একটি ছোট শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ইউরোপ, ব্রিটেন, পশ্চিম এশিয়ার বেশিরভাগ অংশ, উত্তর আমেরিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় সাগরীয় দ্বীপ বেষ্টিত এলাকাগুলোকে নিয়ে গড়ে উঠেছিল বিশাল রোমান সাম্রাজ্য। প্রথম ৪৫০ বছর প্রজাতন্ত্র চালু থাকার পর খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতাব্দীতে জুলিয়াস সিজার এর উত্থান ও পতনের পরিপ্রেক্ষিতে রোম একটি সাম্রাজ্য হয়ে উঠে। এই সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্য সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে হলে আমাদের শুরুর দিকে ফিরে যেতে হবে।

রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা

জুলিয়াস সিজারের নৃশংস হত্যাকান্ডের মাধ্যমে ২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজার সার্বভৌম রোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটান। রোমের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন সম্রাটের মধ্যে তিনি অন্যতম। তিনি রোমের প্রজাতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে শান্তিপূর্ণ রাজ্য গঠনে বিশ্বাসী ছিলেন। অগাস্টাস রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গত এক শতাব্দী ধরে চলমান রাজনৈতিক অশৃঙ্খলতা ও দুর্নীতির অবসান ঘটান। প্রজাতন্ত্রের নামে জনগণের ওপর যে অত্যাচার চলতো অগাস্টাস এসে সেগুলো দূর করেন। সেজন্য তিনি সাধারণ জনগণের প্রিয় ও প্রশংসিত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারসহ সামরিক শক্তিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তার সময়ে রোমান শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্যশিল্প এবং ধর্মের ব্যাপকভাবে প্রচার ঘটে।

আরও পড়ুন:  ব্যাবিলন কোথায় অবস্থিত? ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান কে নির্মাণ করেন?

অগাস্টাস ৫৬ বছর সফলভাবে রাজ্য পরিচালনা করেন। তার জনপ্রিয়তা তার মৃত্যুর পরেও অব্যাহত ছিল এবং সেনেট অগাস্টাসকে ঈশ্বরের সমতুল্য মর্যাদা দেন। তিনি উন্নয়নের যে একটি নবজাগরণ নিয়ে আসেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে রোম সমগ্র বিশ্বে একটি সম্ভ্রান্তশালী রাজ্য পরিণত হয়।

রোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য

অগাস্টাসের পরে আরো অনেক সম্রাট এসেছিলেন যাদের কেউ কেউ অগাস্টাসকে অনুসরণ করেছিলেন আবার কেউ কেউ ভিন্ন পথে হেঁটেছিলেন। সহজ কথায় বলতে গেলে কেউ কেউ ভালো ছিলেন আবার কেউ কেউ খারাপ। ক্যালিগুলা ছিলেন রোমের তৃতীয় সম্রাট যিনি রক্তপিপাসু, পাগলাটে ও অপ্রতিরুদ্ধ সম্রাট হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি ছিলেন প্রথম সম্রাট যাকে পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। নিরোকেও ইতিহাসে ভালভাবে মনে রাখা হয়েছে। একটি প্রচলিত কথা আছে ‘রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল’। এই কথাটি আক্ষরিকভাবে কতটুকু সত্য তা বিতর্কের বিষয়। তবে এর মাধ্যমে এটি স্পষ্ট যে তিনি খুব একটা সুযোগ্য সম্রাট ছিলেন না। নিরো নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সবকিছু করতেন এবং যারা তার এই বিষয়ে নাক গলাতেন তাদের তিনি হত্যা করতেন। কথিত আছে তিনি রোমান কোষাগারের টাকা খেয়াল-খুশিমতো ব্যয় করতেন।

এ সমস্ত বিষয় বাদ দিলে রোমান শাসনামলে সবদিক দিয়েই ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। পৃথিবী বিখ্যাত ফ্ল্যাভিয়ান এম্ফিথিয়েটার যা ‘কলোসিয়াম’ নামে পরিচিত, সেটি নির্মিত হয় রোমান শাসনামলে। সম্রাট ট্রাজান (৯৮-১১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ডেসিয়া এবং পার্থিয়া রাজ্য বিজয়ের পাশাপাশি সর্বাধিক পরিমাণ রোমান সাম্রাজ্য প্রসারিত করেছিলেন। সামরিক বাহিনী ছিল রোমের সাফল্যের অন্যতম প্রধান কারণ। রোমান সেনাবাহিনী উচ্চ প্রশিক্ষিত এবং সুশৃঙ্খল ছিল যার মাধ্যমে বিশ্বের অন্যতম সেরা সেনাবাহিনী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। যুদ্ধে তাদের সাফল্যের মাধ্যমে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বেশিরভাগসহ ৩টি পৃথক মহাদেশে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়। শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্য এত বড় হয়ে গেল যে তাদের এটিকে পূর্ব এবং পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য নামে দুটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত করতে হয়েছিল। এই বিশাল পরিমাণ এলাকার নাগরিকদের ট্যাক্স এর আওতায় নিয়ে আসা হয় যেন সাম্রাজ্যের সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন:  তাজমহল: সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের নিদর্শন

রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন
কলোসিয়াম

ক্ষমতা লাভের পাশাপাশি রোমানরা অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক ব্যতিক্রমী ও উন্নত ছিল। নীতিগত সমস্যার দূরীকরণে তারা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে যাতে করে তাদের জীবনযাত্রা অনেক উন্নত হয়। রোমান প্রকৌশলীরা অন্যদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। যার ফলে ভূগর্ভস্থ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন,সিমেন্ট এবং কংক্রিট ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদী বিল্ডিং তৈরি করা, সেইসাথে বিশ্বের সেরা সড়ক ব্যবস্থা চালু করে। বর্তমানে অনেক রোমান সড়কের অবশিষ্ট অংশ বিদ্যমান রয়েছে যা রোমান সাম্রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য অত্যাবশ্যক ছিল। তারা উন্নত সেনাবাহিনী, কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে বাণিজ্য ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করেছিল। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার, নিরাপদ অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম এবং পদ্ধতি তৈরির মাধ্যমে বিশ্বের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছিল।

রোমান সাম্রাজ্য এর পতন

কোন সাম্রাজ্যই চিরকাল স্থায়ী থাকে না। একইভাবে রোমান সাম্রাজ্যের ও একসময় পতন হয়। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে কোন ভুলগুলোর কারণে রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে? রোমান সাম্রাজ্য পতনের কোন একটি নির্দিষ্ট কারণ নেই, তবে বেশ কয়েকটি কারণ এবং ঘটনা এর চূড়ান্ত পতনের সূত্রপাত করেছিল। তাদের সামরিক ক্ষমতা, অর্থ, ধর্ম সবই এর এক একটি কারণ। সাম্রাজ্যটি একটি শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত ছিল। সামরিক ব্যবস্থায় যখন চিড় ধরে তখন তা আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এছাড়া চাষাবাদযোগ্য জমির কম ব্যবহার, লুটপাট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আস্তে আস্তে নাজুক করে তোলে।
দাসত্ব নিষিদ্ধ করার নতুন আইন প্রণয়নের কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। আস্তে আস্তে খ্রিস্টধর্মের রোমান সমাজকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। তাদের পুরানো ধর্মে সম্রাটকে একজন দেবতা হিসাবে দেখতো, যার কারণে তাদের ক্ষমতার ব্যাপারে জনগণের কখনও দ্বিমত ছিল না। কিন্তু মানুষ আস্তে আস্তে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে সম্রাট এবং সাম্রাজ্যের প্রতি মানুষ সম্মান হারাতে থাকে। সরকারি দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিরোধ এবং ক্ষমতার লড়াই সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দিয়েছিল। সম্রাটের ক্রমাগত মৃত্যু এবং নতুন স্ম্রাট আসার ফলে সম্রাট এবং সেনেটের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব লেগে থাকতো। যদিও এই সমস্যাগুলি নিজেরাই সমাধান করতে পারতো, তবে একই সময়ে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাগুলো সাম্রাজ্যকে ধীরে ধীরে ভেঙে দেয়। রোম একে একে তার প্রদেশগুলো হারাতে থাকে। একে একে আলাদা হয় ব্রিটেন, তারপর স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, গল এবং সবশেষে ইতালি।

Leave a Comment