চিচেন ইতজা: প্রাচীন মায়ান সভ্যতা। Chichen Itza – My bangla blog

চিচেন ইতজা ছিল মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের একটি মায়ান শহর। বর্তমানে এটি একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। অনেক আগে গড়ে উঠা এই স্থানে এখনো প্রত্নতাত্ত্বিকরা নতুন অনেক কিছুই খুঁজে পাচ্ছে। এগুলো মায়ান লোকদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের আগমনের আগে মায়ানরা বর্তমান মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার বেশিরভাগ অংশ শাসন করেছিল। চিচেন ইতজাকে ১৯৮৮ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করে এবং ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী জরিপের মাধ্যমে এটিকে বিশ্বের আধুনিক সপ্তাশ্চর্যের একটি হিসাবে নির্বাচন করা হয়।

চিচেন ইতজা কোথায় অবস্থিত?

চিচেন ইতজা মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপে বর্তমানের রিসোর্টের শহর নামে পরিচিত কানকুন থেকে প্রায় ১২০ মাইল দূরে অবস্থিত। চিচেন ইতজা নামটি মায়ান শব্দ “at the mouth of the well of the itza” বা বাংলায় “ইতজার কূপের মুখে” শব্দ থেকে এসেছে। ইতজা ছিল মায়ানদের একটি জাতিগত গোষ্ঠী যারা ইউকাটান উপদ্বীপের উত্তর অংশে বসবাস করতো। সম্ভবত কূপের জল ছিল সেই শহরের মানুষদের প্রধান পানির উৎস।

চিচেন ইতজা কখন নির্মিত হয়েছিল?

চিচেন ইতজার নির্মানকাল ও সেখানকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে ঐতিহাসিক ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ রয়েছে। কিছু ঐতিহাসিকদের মতে ৪০০ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়, আবার অনেকের মতে পঞ্চম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে শহরটি নির্মিত হয়। প্রায় ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে শহরটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠে।
সে সময়ে এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শহরগুলির মধ্যে একটি। প্রায় দুই বর্গমাইল জুড়ে ছিল ঘনবসতিপূর্ণ বাণিজ্যিক কাঠামো। ছিল ছোট ছোট অনেকগুলো উপনগরী।
চিচেন ইতজার রুক্ষ ভূখণ্ডে নির্মিত হয়েছিল এল কাস্টিলো নামক বিখ্যাত প্রাসাদ যা এখনো টিকে আছে। এটি দেখতে পিরামিডের মত। বর্তমানে মেক্সিকান সরকার এটি পুনরুদ্ধারের জন্য যথাযথ ব্যাবস্থা নিয়েছে।
চিচেন ইতজার আরেকটি বৃহত্তর কাঠামোর নাম লাস মনজাস যা একটি সরকারি ভবন হিসেবে ব্যবহার হতো।
চিচেন ইতজার সমস্ত বিল্ডিং প্রায় ১০০টি পাকা রাস্তা এবং ফুটপাথের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। অবাক করার মত বিষয় হল তখন ইউরোপীয় শহরগুলোতেও পাকা রাস্তার প্রচলন শুরু হয় নি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে মায়ানরা তাদের বিল্ডিংগুলোতে লাল, সবুজ এবং নীল সহ বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙ করতো। যদিও বর্তমানের ধ্বংসাবশেষগুলি রঙ হারিয়ে ফ্যাকাশে ধূসর রঙের হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন:  তাজমহল: সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের নিদর্শন

সেনোট

চিচেন ইতজার উত্তর প্রান্তে রয়েছে একটি বড় সেনোট (পবিত্র কূপ) যার তখনকার সময়ের অনেক আনুষ্ঠানিক তাৎপর্য রয়েছে। বহুদিন ধরে মানুষের মধ্যে একটা গুজব ছিল যে এটা মানব বলিদানের স্থান ছিল।
যাই হোক সেনোটটি ১৯০০ শতকের গোড়ার দিকে ড্রেজ করা হয়। ড্রেজিংয়ের ফলে সোনাসহ অসংখ্য মূল্যবান শিল্পকর্মের পাশাপাশি মানুষের দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। গবেষকদের মতে দেহাবশেগুলোর হাড়ে বিভিন্ন ক্ষত ও ছিদ্র রয়েছে, যা ইঙ্গিত করে সেনোটে নিক্ষেপ করার আগে তাদের হত্যা করা হয়েছিল।

রাজধানী হিসেবে চিচেন ইতজা

নবম শতাব্দীর দিকে চিচেন ইতজা একটি আঞ্চলিক রাজধানী ছিল যার শাসকরা মধ্য ও উত্তর ইউকাটান উপদ্বীপের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করত। উত্তর উপকূলে ইসলা সেরিটোসের বন্দর হয়ে চিচেন ইতজা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়, যা সমগ্র আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন শহরের সাথে সোনা এবং অন্যান্য ধন-সম্পদসহ পণ্যের ব্যবসা করে।
ধারণা করা হয় এই শহরে প্রায় ৫০,০০০ লোক বাস করত। এখানকার বাসিন্দারা বর্তমান মধ্য আমেরিকা সহ ইউকাটানের বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে শহরে অভিবাসিত হয়েছিল।

চিচেন ইতজার পতন

যদিও মায়ান সভ্যতার পতনের জন্য ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আগমনকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়, তবে চিচেন ইতজা হয়তো তারও অনেক আগেই এই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে তার স্থান হারিয়ে ফেলে।
কিছু তথ্য মতে চিচেন ইতজায় ওই সময়ে অভিযান চালিয়ে প্রচুর লুটপাট করা হয়, যদিও এটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
পরবর্তীতে ১৫২ স্প্যানিশরা এখানে এসে বসবাস শুরু করে। আস্তে আস্তে সেখানে তাদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। একসময় স্প্যানিশরা সেখানে একটি অস্থায়ী রাজধানীও স্থাপন করে। এভাবেই আস্তে আস্তে সেখানে মায়ান সভ্যতার পতন ঘটে।

আরও পড়ুন:  অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি: প্রাচীন গ্রীক শিল্পের এক স্মৃতিস্তম্ভ।

চিচেন ইতজার বর্তমান অবস্থা

দীর্ঘ দিন স্প্যানিশ শাসনের ফলে মায়ান সভ্যতার স্থাপত্য গুলো আস্তে আস্তে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে নবগঠিত মেক্সিকোর উত্থানের পর ১৮০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেগুলোর পুনঃরক্ষনাবেক্ষণ শুরু হয়। মেক্সিকান সরকার কর্তৃক স্থাপনাগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টার কারণে মূল শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে:
এল কাস্টিলো: এটি কুকুলকানের মন্দির নামেও পরিচিত যা মায়ান দেবতার নামে নামকরণ করা হয়েছে। দেবতার আকৃতি দেখতে অনেকটা পালকযুক্ত সর্পের মত। এই পিরামিড আকৃতির কাঠামোর উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট।
দ্য গ্রেট বল কোর্ট: এল কাস্টিলোর ঠিক উত্তর-পশ্চিমের এই কাঠামোটি খেলাধুলার জন্য ব্যবহৃত হত।
নর্থ টেম্পল: এটিকে দাড়িওয়ালা মানুষের মন্দিরও বলা হয়। এই ছোট বিল্ডিংটি গ্রেট বল কোর্ট সংলগ্ন এলাকায় অবস্থি। এর ভিতরের দেয়ালে খোদাই করা একটি মানুষের মূর্তি রয়েছে।
স্টিম বাথ: এটি একটি স্নানের জায়গা যেখানে উত্তপ্ত পাথর পানি গরম করার ব্যবস্থা রয়েছে।
স্যাকবে নাম্বার ওয়ান: এটি শহরের পাকা রাস্তাগুলির মধ্যে একটি যা প্রায় ৯০০ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত।
টেম্পল অফ দ্য ওয়ারিয়র্স: এটি আরেকটি বড় ও সিড়িযুক্ত পিরামিড।
এল মারকাডো: টেম্পল অফ দ্য ওয়ারিয়র্সের দক্ষিণ প্রান্তের একটি বর্গাকার কাঠামো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন এটি শহরের একটি বাজার ছিল।
এল ওসারিও: আরেকটি পিরামিড জাতীয় কাঠামো যার শীর্ষে একটি মন্দির রয়েছে।

আরও পড়ুন:  পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য: নাম ও ছবি।

চিচেন ইতজা এর স্থাপনাগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং মায়ানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে বর্তমানে বছরে প্রায় ২০ লক্ষ পর্যটক সেখানে ঘুরতে যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদরা এখনও সেখানে রহস্য উদঘাটনে কাজ করছেন।
2016 সালে বিজ্ঞানীরা আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে এল কাস্টিলোর মধ্যে একটি ছোট পিরামিড আবিষ্কার করেন। মনে করা হয় যে এটি মায়ানদের একটি ধর্মীয় কাঠামো।

Leave a Comment