চীনের মহাপ্রাচীর তৈরির ইতিহাস। The Great Wall of China

চীনের মহাপ্রাচীর হলো পৃথিবীর ইতিহাস বিখ্যাত প্রাচীর বা দুর্গ যার মোট দৈর্ঘ্য ১৩,০০০ মাইলেরও বেশি। এটি চীনের উত্তরে অবস্থিত। চীনের প্রাচীন ইতিহাস ঘাটতে গেলে প্রথমেই আসবে এই মহাপ্রাচীরের কথা। সুবিশাল এই মহাপ্রাচীরটি মূলত সম্রাট কিন শি হুয়াং খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অসভ্য যাযাবরদের আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে যে অংশটি সংরক্ষিত রয়েছে তা মূলত মিং রাজবংশের সময় খ্রিস্টীয় ১৪শ থেকে ১৭শ থেকে শতকের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে যদিও গ্রেট ওয়াল কখনই অধিকাংশ আক্রমণকারীদের চীনে প্রবেশে বাধা দেয়নি, বস্তুত এটি চীন সভ্যতার একটি শক্তিশালী নিদর্শন হিসেবে রয়ে গিয়েছে।

চীনের মহাপ্রাচীর তৈরির ইতিহাস।


তবে চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে, তখন চীন কয়েকটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল।
২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে কিন রাজবংশের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং রাজ্যের পূর্ববর্তী দুর্গ গুলো অপসারণের আদেশ দেন এবং উত্তর সীমান্তে অবস্থিত বেশ কয়েকটি প্রাচীরকে সংযুক্ত করে একীভূত করেন। যার দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ১০,০০০ লি (একটি লি এক মাইলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) যা উত্তর দিক থেকে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন আক্রমণ থেকে চীনকে রক্ষা করে।
“ওয়ান লি চ্যাং চেং” বা ১০,০০০-লি-লং ওয়াল নির্মাণ যে কোনো সভ্যতায় নির্মাণ করা সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি। বিখ্যাত চীনা জেনারেল মেং তিয়ান প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় এই সুবিশাল প্রাচীরটি নির্মাণ করতে সৈন্য, কারাগার বন্দি এবং সাধারণ লোকদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ধারণা করা হয়, চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণের সময় প্রায় ৪০০,০০০ লোক মারা গিয়েছিল। এর মধ্যে অনেক শ্রমিককে প্রাচীরের মধ্যেই চাপা দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন:  অলিম্পিয়ার জিউসের মূর্তি: প্রাচীন গ্রীক শিল্পের এক স্মৃতিস্তম্ভ।

প্রাচীরটি নির্মাণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাটি এবং পাথর ব্যবহার করা হয়। প্রাচীরটি শানহাইগুয়ানের চীন সাগর বন্দর থেকে ৩০০০ মাইল পশ্চিমে গানসু প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। কিছু কিছু বিশেষ জায়গায় সর্বাধিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রাচীরগুলো ওভারল্যাপ করা হয় (বেইজিংয়ের উত্তরে বাদালিং স্ট্রেচ, যা পরবর্তীতে মিং রাজবংশের সময় পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল)।

চীনের মহাপ্রাচীর নিচের দিক থেকে ১৫ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত গভীর এবং মাটি থেকে প্রায় ১৫-৩০ ফুট উঁচু। নিরাপত্তার স্বার্থে নির্দিষ্ট জায়গা পরপর গার্ড টাওয়ার নির্মাণ করা হয়।

কিন শি হুয়াং-এর মৃত্যু এবং কিন রাজবংশের পতনের পর গ্রেট ওয়ালের বেশিরভাগ অংশ রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াই পড়ে থাকে। পরবর্তীতে হান রাজবংশের পতনের পর কয়েকটি সীমান্তবর্তী উপজাতি গোষ্ঠী উত্তর চীন দখল করে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল উত্তরের ওয়েই রাজবংশ, যা অন্যান্য উপজাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রাচীরটি মেরামত ও প্রসারিত করেছিল।

চীনের মহাপ্রাচীর তৈরির ইতিহাস।

বেই কুই রাজবংশ (৫০০-৫৭৭ খ্রিস্টাব্দ) ৯০০ মাইলেরও বেশি স্বল্পস্থায়ী কিন্তু কার্যকর প্রাচীর নির্মাণ এবং মেরামত করেছিল। সুই রাজবংশ (৫৮১-৬১৮ খ্রিস্টাব্দে) বহুবার চীনের মহাপ্রাচীর মেরামত ও প্রসারিত করে। সুই রাজবংশের পতন এবং তাং রাজবংশের উত্থানের সাথে সাথে গ্রেট ওয়াল দুর্গ হিসাবে তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে, কারণ তারা উত্তরে তুজুয়ে উপজাতিকে পরাজিত করার পর মুল সীমান্ত আরও প্রসারিত হয়। সং রাজবংশের সময় উত্তরে লিয়াও এবং জিন জনগোষ্ঠীর হুমকির মুখে প্রাচীর পরবর্তী এলাকাগুলো প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল।

আরও পড়ুন:  রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন। Roman Empire

পরবর্তীতে চেঙ্গিস খানের শক্তিশালী ইউয়ান (মঙ্গোল) রাজবংশ (১২৬-১৩৬৮ খ্রিস্টাব্দ) সমস্ত চীন, এশিয়ার কিছু অংশ এবং ইউরোপের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। মহাপ্রাচীরটি মঙ্গোলদের জন্য সামরিক দুর্গ হিসাবে তেমন বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তবে ঐ সময়ে প্রতিষ্ঠিত ও লাভজনক সিল্ক রোড বিজনেস রুট দিয়ে ভ্রমণকারী বণিক এবং কাফেলাদের রক্ষা করার জন্য প্রাচীরে সৈন্য মোতায়েন করা থাকতো।

কিন রাজবংশের সময় প্রাচীরের নির্মাণ কাজ শুরু হলেও চীনের মহাপ্রাচীর বর্তমানে যেমন অবস্থায় আছে তা নির্মিত হয়েছিল মিং রাজবংশের (১৩৬৮-১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ) সময়ে। মঙ্গোলদের মতো প্রথম দিকের মিং শাসকদের ১৫শ শতকের শেষ পর্যন্ত সীমান্ত দুর্গ নির্মাণে আগ্রহ খুব কম ছিল। ১৪২১ সালে মিং সম্রাট ইয়ংলে পূর্ববর্তী মঙ্গোলিয় শহর দাদুতে চীনের নতুন রাজধানী বেইজিং এর ঘোষণা দেন।

মিং শাসকদের অধীনে চীনা সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ ঘটে এবং এই সময়কালে ব্রিজ, মন্দির, প্যাগোডা, গ্রেট ওয়াল সহ প্রচুর পরিমাণে নির্মাণ কাজ দেখা যায়। মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ ১৪৭৪ সালের দিকে শুরু হয়েছিল। মিং শাসকরা রাজ্য পরিবর্ধনের পর রাজ্যের প্রতিরক্ষায় অনেক সক্রিয় ছিল, যার ধারাবাহিকতায় মহাপ্রাচীরের সংস্কার ও বর্ধন কাজ শুরু হয়।

মিং রাজবংশের সময় নির্মিত প্রাচীর লিয়াওনিং প্রদেশের ইয়ালু নদী থেকে শুরু করে গানসু প্রদেশের তাওলাই নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাওলাই নদীটি বর্তমানে লিয়াওনিং, হেবেই, তিয়ানজিন, বেইজিং, মঙ্গোলিয়া, শানসি ও নিংজিয়া অঞ্চলের পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে।

আরও পড়ুন:  চিচেন ইতজা: প্রাচীন মায়ান সভ্যতা। Chichen Itza - My bangla blog

চীনের মহাপ্রাচীর এর তাৎপর্য

১৭শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মধ্য ও দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলের মাঞ্চুরিয়ানরা গ্রেট ওয়াল ভেঙ্গে বেইজিং দখল করে, যার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে মিং রাজবংশের পতন এবং কিং রাজবংশের শুরু হয়।

১৮শ এবং ২০শ শতকের মধ্যে মহাপ্রাচীরটি সারা বিশ্বে ব্যাপক প্রচার লাভ করে। পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও এটি চীনের সামরিক শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রকাশ পায়।

বর্তমানে গ্রেট ওয়াল বা মহাপ্রাচীরটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও আকর্ষণীয় স্থাপত্যের একটি যা পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্যের একটি বলে বিবেচিত হয়। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো গ্রেট ওয়ালটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর অন্তর্ভুক্ত করে। বিংশ শতকে একটি জনপ্রিয় দাবি উঠে যে এটিই মহাকাশ থেকে দৃশ্যমান একমাত্র মানবসৃষ্ট কাঠামো (যদিও নাসা থেকে তখন এই দাবিটি অস্বীকার করা হয়)।

বর্তমান সময়ে প্রাচীরের বিভিন্ন অংশ কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং শত বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গিয়েছে।
চীনের মহাপ্রাচীরের যে অংশ বর্তমানে দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে তা হল – বেইজিং থেকে ৪৩ মাইল (৭০ কি.মি.) উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত বাদালিং অঞ্চল। ১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে এটা পুনর্নির্মিত হয় যেখানে হাজারো দেশি এবং বিদেশী পর্যটক প্রতিদিন ঘুরতে যায়।

Leave a Comment